চট্টগ্রামের ডাবলমুড়িং এলাকায় ১৯৯৮ সালে বন্ধুকে এসিড নিক্ষেপের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী কামাল হোসেন@ বালু কামাল@ শান্ত দীর্ঘ ২৪ বছর পর চাঁদপুর থেকে র‌্যাব-৭, চট্টগ্রাম কর্তৃক আটক।

১। “বাংলাদেশ আমার অহংকার এই স্লোগান নিয়ে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিভিন্ন ধরণের অপরাধীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে জোড়ালো ভূমিকা পালন করে আসছে। র‌্যাব সৃষ্টিকাল থেকে সমাজের বিভিন্ন অপরাধ এর উৎস উদঘাটন, অপরাধীদের গ্রেফতারসহ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। র‌্যাব-৭, চট্টগ্রাম অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, ডাকাত, ধর্ষক, দুর্ধষ চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, খুনি, ছিনতাইকারী, অপহরণকারী ও প্রতারকদের গ্রেফতার এবং বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মাদক উদ্ধারের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করায় সাধারণ জনগনের মনে আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

২। ভিকটিম হাফেজ মোহাম্মদ জাকারিয়া একজন পবিত্র কোরআনের হাফেজ ছিলেন। তিনি পড়ালেখার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হতে চেয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি তাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় মোঃ রফিকের আগ্রাবাদ কমার্স কলেজের বিপরীত পাশে অবস্থিত দি মেট্রো রেফ্রিজারেশন নামক দোকানে ফ্রিজ মেরামতের কাজ শুরু করেন। উক্ত দোকান জাকারিয়ার দূর সম্পর্কের আত্মীয় রফিক ও তার বন্ধু শাহজাহান (আসামী কামালের বড় ভাই) এর অংশীদারীতে¦র ভিত্তিতে পরিচালিত হত। জাকারিয়া রফিকের ছেলে মেয়েদের আরবী পড়াতেন এবং এলাকার অসংখ্য বাচ্ছাদের পবিত্র কোরআন ও ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। জাকারিয়ার কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও একাগ্রতায় এবং আচার অচরণে মুগ্ধ হয়ে রেফ্রিজারেশন এর মালিক রফিক তাকে খুবই পছন্দ করত এবং আশেপাশের লোকজনও তাকে খুবই সম্মান করত। আসামী মোঃ কামালও উক্ত রেফ্রিজারেশনের দোকানে কাজ করত। তাছাড়া জাকারিয়াকে সবাই পছন্দ ও সম্মান করার বিষয়টিও কামালের ভাল লাগত না। রফিক এক পর্যায়ে দোকান বিক্রয়ের কথা ভাবলে হাফেজ জাকারিয়া দোকান ক্রয়ের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। এজন্য সে জাকারিয়াকে দেখতে পারত না এবং প্রায়ই সে অহেতুক তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া করত।

৩। ঘটনার পূর্বের দিন দোকানের মালিকের অবর্তমানে জাকারিয়া এবং কামাল দোকান খুলে কিছুক্ষণ কাজকর্ম করার পর এক সময় উভয়ের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া হয়। ঝগড়ার এক পর্যায়ে কামাল দোকান থেকে বের হয়ে যায়। বিগত ১৭ সেপ্টেম¦র ১৯৯৮ ইং তারিখে হরতাল ছিল এবং দোকান বন্ধ ছিল। উক্ত দিনে আসামী কামাল জাকারিয়াকে জরুরী কথা আছে বলে দোকানে আসতে বলে। জাকারিয়া দোকানে আসার পর আসামী কামাল সকাল আনুমানিক ০৯০০ ঘটিকায় মগে করে এসিড নিয়ে এসে জাকারিয়াকে বলে তোর জন্য চা এনেছি, চা খা। কিন্তু জাকারিয়া চা খেতে অস্বীকার করে। এতে কামাল ক্ষিপ্ত হয়ে মগ ভর্তি এসিড জাকারিয়ার মুখে নিক্ষেপ করে। ফলে জাকারিয়ার চোখে, মুখে, বুকে, হাতে এসিড দ্বারা দগ্ধ হয়ে ঝলসে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় জাকারিয়া হতবিহব্বল হয়ে যায় এবং এসিডে তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকে। এসিড নিক্ষেপের পরও জাকারিয়ার মৃত্যু না হওয়ায় মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য কামাল দিয়াশলাই দিয়ে ভিকটিমের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং পা দিয়ে কয়েকটি লাথি দিয়ে ঘটনাস্থল হতে পালিয়ে যায়।

৪। গুরুতর আহত জাকারিয়ার চিৎকারের আশেপাশের লোকজন এসে প্রায় মৃত অবস্থায় তাকে দেখতে পেয়ে ডবলংমুরিং থানায় সংবাদ দেয়। ডবলংমুরিং থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে জাকারিয়াকে মৃত মনে করে থানায় নিয়ে যায়। থানায় নিয়ে যাওয়ার পর ডিউটিরত প্রহরী হঠাৎ লক্ষ্য করেন জাকারিয়ার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। পরবর্তীতে ডবলংমুরিং থানা পুলিশ দ্রুত গুরুতর আহত জাকারিয়াকে পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যায়। টানা চারদিন সেখানে হাফেজ জাকারিয়ার শরীরে পোড়াও ঝলসানো স্থানে পানি ঢালা ও চিকিৎসা প্রদান করা হয়। চারদিন পর তার জ্ঞান ফিরে। কিন্তু জাকারিয়ার চোখ এবং শরীরে এসিডে ঝলসানোর ভয়াবহতা দেখে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সেখানে হাফেজ জাকারিয়া সর্বপ্রথম আয়নায় নিজের বিভৎস চেহারা দেখে অজ্ঞান হয়ে যায় এবং ৩০ দিন কোমায় থাকে। পরবর্তীতে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় জাকারিয়াকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। এসিডের ফলে জাকারিয়ার এক চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়, চোখের পাপড়ি ঝলসে যায় এবং মুখে, বুকে ও হাতে এসিড দ্বারা ঝলসে যায়। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর জাকারিয়ার মোটামুটি সুস্থ্য হওয়ার পর সৌদি আরব চলে যায়।

৫। উক্ত ঘটনায় ভিকটিমের বাবা মোহাম্মদ ইউনুস মিয়া বাদী হয়ে পরদিন ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ ইং তারিখে ডবলমুরিং থানায় একটি মামলা দায়ের করেন যার মামলা নং-৩৯ তারিখ ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ইং, ধারা ৩২৬(ক) পেনাল কোড। ঘটনার পর হতে ডবলমুরিং থানা পুলিশ পলাতক আসামী কামালকে গ্রেফতারের লক্ষ্যে অনেকবার অভিযান পরিচালনা করে কিন্তু ধূর্ত ও চালাক কামালকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়। গত ২৪ এপ্রিল ২০২২ইং তারিখে চট্টগ্রামের বিভাগীয় বিজ্ঞ বিশেষ জজ আদালত আসামী মোঃ কামালকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ১ লক্ষ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ২ বছর কারাদন্ড প্রদান করেন।

৬। র‌্যাব-৭, চট্টগ্রাম উক্ত মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামীকে গ্রেফতার করার লক্ষ্যে গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-৭, চট্টগ্রাম জানতে পারে উক্ত মামলার উক্ত মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামী মোঃ কামাল হোসেন চাঁদপুর জেলার শাহরাস্থি থনাধীন মেহের ষ্টেশন রোড এলাকায় অবস্থান করছে। উক্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ইং তারিখ ১৪৪৫ ঘটিকায় উক্ত মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী মোঃ কামাল হোসেন, পিতা-রসুল করিম, সাং-কাউনিয়া, থানা-ফরিদগঞ্জ, জেলা-চাঁদপুরকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে উপস্থিত সাক্ষীদের সম্মুখে প্রাথমিক জিজ্ঞসাবাদে আসামী স্বীকার করে, সে বর্ণিত মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামী।

৭। ঘটনার পর আসামী কামাল কিছুদিন পলাতক থাকার পর একসময় তার নিজ এলাকা চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ চলে আসে। পরবর্তীতে বর্ণিত অপরাধ ছাড়াও সে তার এলাকায় বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ছিল। সেখানে ১৯৯৮ হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত ষ্টুডিওর কর্মচারী হিসেবে ছবি উঠানো, বিয়ে বাড়ীর প্যাকেজিং প্রোগ্রাম এর কাজ করত। ২০০১ সাল হতে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সে নিজ ও অন্য এলাকায় কঠোর গোপনে কৃষিকাজ করে। ২০০৩ হতে ২০০৭ সাল পর্যন্ত লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ থানায় দায়েরকৃত ডাকাতির মামলায় জেল হাজতে ছিল। ২০০৭ সালে জেল হতে মুক্তি পাওয়ার পর সে যাত্রাবাড়ির কাচাঁমালের আড়তে সবজীর পাইকারী ও খুচরা বিক্রয়ের ব্যবসা শুরু করে। ২০১০-২০১১ সালে সে পূনরায় ডাকাতির প্রস্তুতির দায়েরকৃত মামলায় হাজতবাস করে। ২০১১-২০১৩ সালে জেল হতে মুক্তি পেয়ে অদ্যাবধি সে তার নিজ ও অন্য এলাকায় ছদ্মবেশে কৃষিকাজ করছিল। ২০১৩ সালে তার মাথায় বুদ্ধি আসে, এবং সে তার এলাকা ছেড়ে দেয় এবং চাদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থেকে শাহারাস্থিতে চলে এসে জমি কিনে বালু ব্যবসা শুরু করে। সেখানে সে সবাইকে তার স্থায়ী ঠিকানা বলে পরিচয় দিত। এলাকার মানুষজন জানত এটাই তার স্থায়ী ঠিকানা।

৮। সিডিএমএস পর্যালোচনা করে গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে লক্ষীপুর জেলার রায়গঞ্জ থানায়-০১ টি এবং চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানায় ০৬টি চুরি, ডাকাতি, নাশকতা এবং মাদক সংক্রান্ত মামলা এবং চট্টগ্রাম মহানগরীর ডবলমুরিং থানায় ০১টি এসিড নিক্ষেপ সংক্রান্ত মামলা পাওয়া যায়।

৯। উল্লেখ্য, হাফেজ মোঃ জাকারিয়া বর্তমানে সৌদি আরব কর্মরত রয়েছেন। তিনি বিবাহিত এবং তার ২টি সন্তান রয়েছে। দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকায় তার লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। এসিডে ঝলসে যাওয়ার পর হতে তার শরীর সব সময় জ্বালাপোড়া করে এবং সবসময় পাতলা কাপড় পড়ে থাকতে হয়। চোখের পাপড়ী ঝলসে যাওয়ায় তিনি এক চোখ কখনো বন্ধ করতে পারেন না। এছাড়া এক নাগাড়ে তিনি বেশিক্ষণ কাজ করতে পারেন না এবং রোদে যেতে পারেন না। দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে তিনি এ অসহ্য জ্বালা যন্ত্রণা ভোগ করছেন যা তিনি আমৃত্যু বহন করবেন। দীর্ঘ ২৪ বছর পর পলাতক আসামী কামাল হোসেন@ বালু কামাল@ শান্ত গ্রেফতার হওয়ায় ভিকটিম ও তার পরিবার সন্তোষ প্রকাশ করেন।

১০। গ্রেফতারকৃত আসামী সংক্রান্তে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের নিমিত্তে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তরের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।